নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর
সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আনার জন্যই মা-বাবা তাদেও সন্তানকে কাজে দিয়েছিলেন রশীদ অটোরাইস মিলে। গত রবিবার সকালে কাজে যাবার আগে ছেলে মা'কে জানিয়েছিল, বিকেল বাড়িতে এসে দুপুরের খাবার খাবে। সে ছেলে ঘরে ফিরল ঠিকই, কিন্তু লাশ হয়ে।
রবিবার বিবেল ৪টার কিছু পর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গড়মাটি কলোনীপাড়ায় রশীদ অটোরাইস মিলের ভেতর রহস্যজনক মৃত্যু হয় একই গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে সোহান হোসেনের (১৭)। বিকেলে মৃত্যু হলেও অজানা কারণে ৫ ঘন্টা পর শিশু শ্রমিক সোহানের লাশ পাঠানো হয় তার বাড়িতে। সদা হাস্যোজ্জ্বল কিশোরের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ। রহস্যজনক কারনে এ মৃত্যু নিয়ে মুখে কুলুপ এটেছে সোহানের পরিবারের একাংশ। অন্যদিকে, নিহত সোহানের দুই চাচা মকলেসুর রহমান ও ইলিয়াস হোসেন এ মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মিলের ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সোমবার সকালে ভেতরে কোন ক্যামেরা পাওয়া যায়নি। ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হলেও, অজানা কারণে লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। সোমবার বাদ জোহর সোহানের মরদেহ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সোমবার সকালে গড়মাটি কলোনীপাড়ায় সোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠোনে মৃতদেহ ঘিরে কান্নার রোল জুড়ে দিয়েছে পরিবার। ছেলের নিথর দেহের পাশে শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন মা। মায়ের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসছে একটাই কথা, ‘ছলেটা আমার ভাত খেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে মিল থেকে ফিরল লাশ হয়ে। তিনি বলেন, ছেলের মৃত্যুর ১৯ ঘন্টা পরও মিলের কেউ আসেনি আমার বাড়ীতে।’
বাড়িতে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে দূর থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন সোহানের চাচা ইলিয়াস। অশ্রুসজল চোখে তিনি অভিযোগ করেন, ‘রশীদ মিল কর্তৃপক্ষ আমার ভাতিজার মৃত্যুতে একটিবারও দেখতে আসেনি। এতো টাকার দাপট তাদের, আমার ভাতিজার প্রাণ চলে গেল তাদের মিলের ভেতর। অপর চাচা মোকলেসুর রহমান অভিযোগ করেন, বিকেলে সোহানের মৃত্যু হলেও রাতে পরিবারের কাছে জানায় মিল কর্তৃপক্ষ। মিলের ভেতরে ট্রাক চাপায় মৃত্যু হয়েছে, এমনটা মেনে নেয়া যায় না!
এদিকে বাড়িতে সাংবাদিকদের উপস্থিত হওয়ার খবরে পুলিশ ছুটে আসে। তবে প্রতিবেশীদের অভিযোগ, ঘটনার রাতে পুলিশ ওই মিলে গেলেও নিহত সোহানের বাড়িতে আসেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক কৃষক জানান, রশীদ অটোরাইসমিলের বিষয়ে কেউ ভয়ে মুখ খোলে না। খুললেই প্রাণনাশসহ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের হুমকি দেয়া আছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে রশীদ অটোরাইসমিলে যাওয়া হলে নিরাপত্তাকর্মীরা প্রথমে সাংবাদিকদের ভেতরে যেতে দেয়নি। পরে শর্তসাপেক্ষে ভেতরে যাবার অনুমতি মিললেও কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। এ সময় সেলফোনে মিলের জিএম এডমিন নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মূল ফটকে পার হয়ে যান। মিলের প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করলে ভেতরে ওই কর্মকর্তাকে দেখা যায়। তিনি সোহানের জানাজার নাম করে পুনরায় বেরিয়ে পড়েন। ফিরে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ঘটনার বিষয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন। এসময় তিনি এক ব্যক্তিকে নিহতের পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখিয়ে বলেন, সোহানের মৃত্যু পর থেকে জানাজা অবধি তিনি পাশে ছিলেন।
একজন শ্রমিক মৃত্যুর পর কিভাবে প্রতিষ্ঠানটি কেন এক মুহূর্তের জন্য কাজ বন্ধ করে সহমর্মিতা জানালো না জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, চাউল উৎপাদনের মেশিন একবার বন্ধ করলে আটদিন লাগে চালু হতে, তাই উৎপাদনের ধারাবাহিকতা চিন্তা করেই কোন বিরতি রাখা হয়নি। আর সিসি ক্যামেরাগুলো বিকল হওয়ায় সেগুলো মেরামত করতে দেয়া হয়েছে। একপর্যায়ে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে পুলিশের সাথে কথা বলতে বলেন।
এ ব্যাপারে বড়াইগ্রাম থানায় গেলে প্রথমে ওসি শাহরিয়ার খানকে পাওয়া যায়নি। থানার ভেতরে সার্ভিস ডেলিভারী সেন্টারের টেবিলের নীচে আশ্চর্যজনকভাবে রশীদ অটোরাইসমিলের একটি খন্ডিত খাম পাওয়া যায়। পরে ওসি এসে সাংবাদিকদের বলেন, এখন সোহানের মৃত্যুর ঘটনায় কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শিশু শ্রমিক নিহতের ঘটনায় নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে মিল কর্তৃপক্ষ সোহানের পিতা আব্দুল জলিলকে নিয়ে তার দপ্তরে আসেন। সোহানের পিতা ছেলের মৃত্যু নিয়ে কোন অভিযোগ না করায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, রশিদ অটো রাইস মিলটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানে দুই শিফটে প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করে। সোহানের পূর্বেও এখানে আরও একজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।




Comments
Post a Comment